বাংলাদেশে শরণার্থী নয় লাখ রোহিঙ্গাকে ৩৭ লাখ ৬৫ হাজার ৪৯৯ ডোজ ডায়রিয়ার টিকা দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীতে সম্ভাব্য ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাবের প্রতিরোধ সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র’ বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)।
রোববার (৫ মার্চ) কক্সবাজারের লং বিচ হোটেলে ‘জরুরি স্বাস্থ্যসেবা (তীব্র পানির মতো ডায়রিয়ার জন্য প্রস্তুতি ও সাড়া প্রদান) ও জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের ক্যাম্পে এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীতে কলেরা নজরদারি’ শীর্ষক প্রকল্পের কার্যক্রম ও ফলাফল তুলে ধরতে আয়োজিত সেমিনারে এসব তথ্য জানানো হয়।
ইসিডিডিআরবির হাসপাতাল প্রধান ডা. বাহারুল আলম প্রকল্পের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এবং ২০১৭ সালে নিপীড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার সাথে সাথে দ্রুত আইসিডিডিআরবি ও ইউনিসেফের যৌথ পরিচালনায় একটি মাঠ পর্যায়ের মূল্যায়ন সম্পর্কে অবহিত করেন।

সেমিনারে জানানো হয়, প্রকল্পটির আওতায় রোগের নজরদারি, চিকিৎসা, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং টিকাদানের মাধ্যমে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে আইসিডিডিআরবি, ইউনিসেফ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় ২০১৮ সাল থেকে দুই হাজার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। টেকনাফে পাঁচটি ডায়রিয়া চিকিৎসা কেন্দ্র (ডিটিসি) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যা সেপ্টেম্বর ২০১৯-এর ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করে। লেদা ডায়রিয়া চিকিৎসা কেন্দ্রের কার্যক্রম এখনও চলমান রয়েছে এবং এখানে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে তিন হাজার রোগীর চিকিৎসা করা হয়। এছাড়া কেন্দ্রটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃত্বে চলমান যৌথ মূল্যায়ন দলেও অংশ নিচ্ছে।
আইসিডিডিআরবির নিউট্রিশন অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল সায়েন্স বিভাগের ইমেরিটাস সায়েন্টিস্ট ড. এএসজি ফারুক ডায়রিয়া চিকিৎসা কেন্দ্র- ভিত্তিক নজরদারির ফলাফল উপস্থাপন করেন। তিনি জানান, রোহিঙ্গা শিশুদের মধ্যে (বয়সের তুলনায় কম উচ্চতা) ও কৃশকায় (উচ্চতার তুলনায় কম ওজন) এবং ওজন স্বল্পতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি দেখা গিয়েছে। সেইসাথে এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্লোরিনযুক্ত ট্যাপের পানির ব্যবহার, টয়লেট ব্যবহার, খাবার স্যালাইন এবং টিকা গ্রহণের হারও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

আইসিডিডিআরবির ইনফেকশাস ডিজিজেস ডিভিশনের ভারপ্রাপ্ত সিনিয়র ডিরেক্টর ড. ফেরদৌসী কাদরী কক্সবাজারে মুখে খাওয়ার কলেরা টিকাদান কার্যক্রমের সাফল্য তুলে ধরে বলেন, সাত দফায় টিকাদান কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্যাম্পে মানুষকে শতভাগ টিকাদান করা হয়েছে। প্রায় নয় লাখ রোহিঙ্গা জনগণ ৩৭ লাখ ৬৫ হাজার ৪৯৯ ডোজ টিকা পেয়েছে। একইসঙ্গে রোহিঙ্গাদের কাছাকাছি বসবাসকারী পাঁচ লাভ ২৮ হাজার ২৯৭ স্থানীয় জনগণ আট লাখ ৯৫ হাজার ৬৮৮ ডোজ মুখে খাওয়ার কলেরা টিকা পেয়েছে। এরকম জটিল পরিবেশেও টিকাদান কর্মসূচি ভালোভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এই এলাকায় রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীতে কলেরা প্রাদুর্ভাব ও মহামারি প্রতিরোধে মুখে খাওয়ার কলেরা টিকাদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, যা বড় রকমের কোনো প্রাদুর্ভাবের অনুপস্থিতি থেকে প্রমাণিত হয়। এটি সম্ভব হয়েছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়, সিডিসি-ডিজিএইচএস, আইইডিসিআর, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফসহ আমাদের অন্যান্য অংশীদারদের অসামান্য নেতৃত্ব এবং সমর্থনের মাধ্যমে।’

ইউনিসেফের হেলথ স্পেশালিস্ট ডা. মাইনুল হাসান আইসিডিডিআরবির প্রশংসা করে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের মধ্যে তীব্র পানির মতো ডায়রিয়ার রোগ নিয়ন্ত্রণের এই সফল কার্যক্রমের অংশীদার হতে পেরে ইউনিসেফ গর্বিত। আমাদের কার্জক্রমগুলো চালিয়ে যাওয়া দরকার এবং আমরা বিশ্বাস করি সকলে একসাথে এসব রোগ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হব।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি ডা. হোর্হে মাটিনেজ তার বক্তব্যে রোগের নজরদারি, টিকাদান এবং অন্যান্য ব্যবস্থার গুরুত্ব তুলে ধরেন এবং দ্রুত রোগ নির্ণয়ের জন্য কক্সবাজারের সক্ষমতা কীভাবে আও বাড়ানো যায়, তা খুঁজে দেখার জন্য আইসিডিডিআরবিকে অনুরোধ করেন।
সভাপতির বক্তব্যে আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ বাংলাদেশের সরকার এবং উন্নয়ন অংশীদারদের সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টার প্রশংসা করে বলেন, ‘সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা শুধু ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধে এবং জীবন বাঁচাতে সাহায্য করেনি বরং আমাদের এমন কিছু প্রমাণ এনে দিয়েছে যা পৃথিবীর অন্যান্য যেকোনো জায়গায় মানবিক সংকট মোকাবেলায় কাজে দেবে।’
ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, এখন পর্যন্ত সাফল্য পেলেও, এটা স্পষ্ট যে শরণার্থী শিবিরে ভবিষ্যতে প্রাদুর্ভাব রোধ করার জন্য টেকসই প্রচেষ্টা প্রয়োজন। টিকা দেওয়ার পাশাপাশি, একটি শক্তিশালী এবং টেকসই পানি, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি হস্তক্ষেপ, একটি বিস্তৃত নজরদারি ব্যবস্থা এবং সঠিক কেস ব্যবস্থাপনা এরকম মানবিক সংকটাপূর্ণ স্থানে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব রোধ করার জন্য প্রয়োজনীয়। সেমিনারটি কক্সবাজারের বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। অব্যাহত সহযোগিতা এবং টেকসই প্রচেষ্টার মাধ্যমে, আশা করা যায় যে ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়ের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এ ধরনের সাফল্য অর্জন করা যেতে পারে।
Discussion about this post